কৃষি জমি কমেই চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

প্রকাশিত: ৫:৫৪ অপরাহ্ণ , ১৯ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 4 years আগে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার আহরন্দ এলাকায় কৃষি জমি বালু দিয়ে ভরাট করছে। ছবি-কালের বিবর্তন

জহির রায়হান : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় আশংকাজনক হারে কমছে কৃষি জমি। অপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প, শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে ক্রমেই কমছে এ কৃষি জমির পরিমাণ। এছাড়াও এসব ফসলি জমিতেই নির্মাণ করা হচ্ছে রাস্তা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও দোকানপাটসহ বিভিন্ন রকমের স্থাপনা।

এসব কারণে গত ১০ বছরে জেলার মোট ফসলী জমি থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৫ হেক্টর জমি হ্রাস পেয়েছে। ইতিপূর্বে নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারনে যে হারে আবাদী জমি হ্রাস পেতো, বর্তমানে ফসলী জমিকে কেউ কেউ ভিটেবাড়ি কেউবা আবার জলাধারে রূপান্তরিত করে মাছ চাষের আওতায় আনার কারনে তার চেয়ে অধিক হারে এখন কমে যাচ্ছে কৃষি জমি।

বিশ্লেষকদের মতে, ফসলী জমি রক্ষায় কোন সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় অবাধে বিনাশ করা থেকে জমি বাচাঁতে পারছে না প্রশাসন। ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে নিয়মিত মনিটরিং ও ফসলী জমি সুরক্ষায় সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভার মত ইউনিয়ন পরিষদেও প্ল্যান পাশের মাধ্যমে আবাসন প্রকল্প/শিল্পায়ন গড়ে তুলতে সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে নীতিমালা প্রনয়ণের তাগিদ দিয়েছেন সুশীল সমাজ।

কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ এই দুই অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় একফসলি, দুইফসলি, তিনফসলি ও চারফসলি জমি মিলে নেট ক্রপ এরিয়া যেটা বর্তমানে আছে ১ লাখ ৩১ ৯৭৮ হেক্টর জমি। যা বিগত দুই বছর আগে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৮৫ হেক্টর ছিলো। এই দুই বছরে ২০৭ হেক্টর জমি কৃষি খাত থেকে অকৃষি খাতে রুপান্তরিত হয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী গত এক দশকে প্রায় ১ হাজার ৩৫ হেক্টর কৃষি জমি হ্রাস পেয়েছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, জেলার নয় উপজেলাতেই ফসলী জমিকে পাল্লা দিয়ে রূপান্তরিত করা হচ্ছে বড় বড় পুকুর-দীঘিতে। যেখানে কৃষকরা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে করছেন মাছ চাষ। এই চিত্র সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা গেছে সদর উপজেলাসহ পূর্বাঞ্চলের কসবা, আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার সর্বত্র।

এছাড়াও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে কৃষকদের কাছ থেকে ফসলি জমির মাটি কিনে নিয়ে আবার সেই মাটি ড্রেজার দিয়ে কেটে কৃষকদের কাছেই বিক্রি করছে। এসব মাটি দিয়ে রাস্তার ধারের জমি ভরাট করে কেউ নির্মান করছেন মার্কেট আবার কেউবা করছেন হাউজিং প্রকল্প।

তবে ফসলি জমি ভরাটের মহোৎসব চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী খননের ড্রেজারের মাটি দিয়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার আহরন্দ এলাকা থেকে শুরু করে আখাউড়া উপজেলার ধরখার পর্যন্ত কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের চারপাশের প্রায় কয়েকশো একর জমি ইতিমধ্যেই ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়াও ধরখার থেকে শুরু করে রানিখার, ঘোলখার, আদিলপুর, নুরপুর ও রুটি গ্রামে এখন চলছে ফসলি জমি ভরাটের মহোৎসব। এসব ফসলি জমি ভরাটের জন্য অল্পদামে মাটি দেওয়ার কথা বলে কৃষকদের নানাভাবে উদ্ভুদ্ধ করছে একশ্রেণীর অসাধু সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে এসব সিন্ডিকেটের মদদদাতা হিসেবে কাজ করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। এভাবেই দিনদিন কৃষি জমিগুলো কমে অকৃষিখাতে রুপান্তরিত হচ্ছে।

রহিম মিয়া, ফজলু মিয়া, নুরু মিয়াসহ আরো বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বললে তারা জানান, গত ৫-৭ বছর যাবৎ ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করে কৃষক বরাবরই লোকসানে পরার কারনে ধান চাষে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এজন্য কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা ফসলি জমিতে কেউ করছেন মাছচাষ আবার কেউবা কৃষি জমি ভরাট করে নির্মান  করেছেন মার্কেট ও দালানকোঠা।

এ বিষয়ে খেলাঘরের জাতীয় পরিষদ সদস্য ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ পাল বাবু বলেন, কৃষি জমি এখন বানিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইটভাটা থেকে শুরু করে যেকোন ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপনায় শুরুতেই নজর যায় কৃষি জমির দিকে। কৃষি জমির ব্যবহারে যে নীতিমালা আছে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদস্য ও সমকালের নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর নূর বলেন,  বাংলাদেশে যেভাবে ফসলি জমি কমেছে এবং যেভাবে জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। এতে করে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে যতই খাদ্য-শষ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করুক না কেন, ভবিষ্যতে আমাদের খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হতে হবে। এমতাবস্থায় কেউ যেন ফসলি জমিতে বাড়িঘর নির্মান করতে না পারে, সেজন্য সরকারকে অবশ্যই কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটির সদস্য ও দৈনিক যায়যায়দিনের নিজস্ব প্রতিবেদক মো: বাহারুল ইসলাম মোল্লা বলেন, পরিকল্পনার অভাবেই দিনদিন কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। পৌরসভার মত যদি ইউনিয়ন পরিষদেও পরিকল্পনা অনুযায়ী প্ল্যান পাশ করে বাড়িঘর নির্মান করা হতো, অথবা শহরের মত যদি গ্রামেও সামান্য একটু জায়গার মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণে সাধারণ মানুষের মানসিকতা তৈরি হতো। তবে আমাদের দেশের ফসলি জমি এভাবে হ্রাস পেতো না।

তিনি মনে করেন, শহরের পৌরসভার মত গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পরিকল্পিতভাবে প্ল্যান পাশের মাধ্যমে বাড়িঘর নির্মান করা হলে কৃষি জমি রক্ষা করা সম্ভব হবে।

কৃষি জমি যে হ্রাস পেয়েছে এটা স্বীকার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের রিসার্চ অফিসার রুনায়েত আমিন রেজা বলেন, জেলায় কি পরিমাণ কৃষি জমি হ্রাস পেয়েছে তার কোন সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে বর্তমানে জেলায় যে পরিমাণ ইটভাটা রয়েছে তা বিগত দশ বছরে বেড়েছে প্রায় দিগুণ।

তিনি বলেন, একটা ইটভাটা স্থাপন করতে ৫ একর জমির প্রয়োজন। সে হিসেবে ১’শ টি ইটভাটা তৈরি করতে ৫’শ একর জমির প্রয়োজন। এতে করে দেখা যায়, গত দশ বছরে শুধুমাত্র ইটভাটা স্থাপন করতে ৫’শ একর জমি হ্রাস পেয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: আবু নাছের বলেন, কৃষি জমি হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন, শিল্প, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর নির্মান ইত্যাদি। তিনি বলেন, কোন কৃষি জমি যেন অকৃষি খাতে রুপান্তরিত না হয় সেজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন সভা সেমিনারে জেলা প্রশাসকের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও সরাসরি কৃষকদের সাথে যোগাযোগ করে জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করি, যাতে করে কোন কৃষক কৃষি জমিকে অকৃষি খাতে রুপান্তরিত না করেন।

তিনি আরো বলেন, ইতিপূর্বে যে পরিমান কৃষি জমি হ্রাস পেয়েছে এতে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস পায়নি বরং উৎপাদনের সেই লক্ষ্যমাত্রা অব্যাহত রয়েছে।

মন্তব্য লিখুন

আরও খবর